ভারতে তীব্র গরমে দিশেহারা মানুষ

গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ পিক আসতে এখনো অনেক বাকি, কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝিই ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে।

রাজস্থানের বুন্দিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে, ওদিকে পূর্ব ভারতেও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ৬-৭ ডিগ্রি বেশি চলছে। তীব্র গরমে আর দাবদাহে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের।

উত্তরপ্রদেশের হামিরপুর ও প্রয়াগরাজের (এলাহাবাদ) মতো জায়গায় ৪৪ দশমিক দুই ডিগ্রি তাপমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

রাজধানী দিল্লিতেও আজ নিয়ে টানা পাঁচদিনের মতো সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে- যা এই সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় চার ডিগ্রি বেশি।

এর আগে চলতি মাসের গোড়াতেই ভারতের আবহাওয়া দফতর সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ এলাকাতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকবে- অর্থাৎ এবারের গ্রীষ্ম হবে চরমতম।

দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের বেশিটা এবং সমগ্র পূর্ব ও মধ্য ভারত এই সতর্কবার্তার আওতায় ছিল, শুধু দাক্ষিণাত্য এই চরম তাপপ্রবাহ থেকে রেহাই পাবে বলে পূর্বাভাস করা হয়েছিল।

এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আবহাওয়ার যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে সেই পূর্বাভাস অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।

পাশাপাশি এই ধরনের তাপমাত্রা মোকাবেলার কতটা ক্ষমতা ভারতের আছে, বিশেষজ্ঞরা এখন সেই প্রশ্নও তুলতে শুরু করেছেন।

‘হিট অ্যাকশন প্ল্যান’
দেশের একটা শহর যখন অপ্রত্যাশিত বেশি তাপমাত্রায় পুড়তে থাকে, তখন কিভাবে তার মোকাবেলা করা সম্ভব এবং কিভাবে গরমে প্রাণহানির সংখ্যা কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গুজরাটে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের কর্মকর্তা দিলীপ মভলঙ্কর।

২০১৩ সালে তিনি আহমেদাবাদ শহরের জন্য দেশের প্রথম ‘হিট অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রস্তুত করেছিলেন।

সেই পরিকল্পনায় তাপপ্রবাহের মোকাবেলায় কতগুলো সহজ রাস্তা বাতলানো হয়েছিল- যেমন যতটা সম্ভব বাড়ি বা অফিসের ভেতরে থাকা, বাইরে বেরোনোর আগে প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়া, অসুস্থ বোধ করলেই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যাওয়া ইত্যাদি।

তাছাড়া তাপমাত্রার অবস্থা বুঝে শহরের জন্য তিন ধরনের ‘কালার কোডেড’ অ্যালার্টও চালু করা হয়েছিল।

তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি ছাড়ালেই চালু হয়ে যেত সর্বোচ্চ রেড ওয়ার্নিং অ্যালার্ট।

পাঁচ বছর ধরে আহমেদাবাদে এই পরিকল্পনা বলবৎ করার পর দেখা যায় যে ২০১৮ সালের মধ্যেই ওই শুষ্ক, গরম শহরে ‘তাপজনিত অতিরিক্ত মৃত্যু’র সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে।

ড: মভলঙ্কর জানাচ্ছেন, এর আগের বেশ কয়েক বছরের মৃত্যুর পরিসংখ্যানের সাথে তুলনা করে ‘তীব্র গরম’ একটা সপ্তাহে বাড়তি কতগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তিনি সেই হিসেবটা কষেছিলেন।

বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, শুধু তীব্র গরম আর তাপমাত্রার জন্য এ দেশে যে বহু লোক মারা যাচ্ছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গরম যে কতটা মারাত্মক হতে পারে এবং জীবন পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে, দেশের মানুষ কিন্তু আজও সেটা বুঝেই উঠতে পারেননি, বলেন মভলঙ্কর।

শ্রমিকরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে
আহমেদাবাদে দেশের প্রথম হিট অ্যাকশন প্ল্যান চালু হওয়ার পর এক দশক অতিক্রান্ত, কিন্তু দেশের বিভিন্ন অংশে এই পরিকল্পনাগুলো যে খুব ভালোভাবে কাজ করছে তা কিন্তু বলা যাবে না।

গত সপ্তাহেই মহারাষ্ট্রের নভি মুম্বাইতে তীব্র গরমে ও খোলা আকাশের নিচে সরকার যখন একটি হাই-প্রোফাইল জনসভার আয়োজন করেছিল, তা থেকেই বোঝা যায় সেখানে কোনও হিট অ্যাকশন প্ল্যান প্রস্তুত রাখা প্রশাসনের রাডারেই ছিল না।

দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী সেই জনসভায় ভাষণ দেন- ওদিকে তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ে সভায় অংশ নেয়া অন্তত ১৪ জন প্রাণ হারান।

দেশের বিভিন্ন শহর, জেলা ও রাজ্য পর্যায়ে চালু করা ৩৭টি হিট অ্যাকশন প্ল্যান পর্যালোচনা করে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের দু’জন গবেষক, আদিত্য ভালিয়াথান পিল্লাই ও তামান্না দালাল দেখিয়েছেন এগুলোর প্রয়োগের ক্ষেত্রে আসলে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।

তারা বলছেন, বেশির ভাগ প্ল্যানই ওই অঞ্চলের ‘স্থানীয় কনটেক্সটে’র সাথে মানানসই করে প্রস্তুত করা হয়নি।

মোট ৩৭টির মধ্যে মাত্র ১০টি পরিকল্পনায় স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী তাপমাত্রার সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।

পিল্লাই বিবিসিকে জানান, তীব্র গরমে কোন শ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালনারেবল বা ঝুঁকির মুখে, প্ল্যানে সেটাও নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্য আমরা সুপারিশ করেছি।

বস্তুত ভারতের শ্রমিকদের তিন-চতুর্থাংশই মাইনিং (খনি) বা কনস্ট্রাকশন (নির্মাণ শিল্প) খাতে কাজ করেন, যেখানে ‘হিট এক্সপোজার’ মারাত্মক রকম বেশি- অর্থাৎ প্রচণ্ড গরমে তাদের কাজ করতে হয়।

প্রতিটি হিট অ্যাকশন প্ল্যানে এই ধরনের ভালনারেবল জনগোষ্ঠীকে আলাদা করে চিহ্নিত করার ওপরে বিশেষজ্ঞরা এখন জোর দিচ্ছেন।

তবে ভারতের সাধারণ মানুষ এখনো এই তাপপ্রবাহকে ‘ততটা সিরিয়াসলি’ নিচ্ছেন না বলেই তাদের ধারণা।

আদিত্য ভালিয়াথান পিল্লাই যেমন বলছিলেন, আমি নিজে দিল্লিতে থাকি, যেখানে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়।

তবু কেন এই শহরের বেশির ভাগ মানুষ ছাতা ব্যবহার করেন না, সেটা আমার মাথাতেই ঢোকে না!
সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *